» পবিত্র কুরআনের অর্থানুবাদের ভূমিকা

মুখবন্ধ

আল-কুরআনুল কারীম আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী। শব্দ ও অর্থসহ তা তিনি নাযিল করেছেন তাঁর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত, সুসংবাদদাতা, ভীতিপ্রদর্শনকারী আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তাঁর দিকে আহ্বানকারী এবং উদ্দীপ্ত আলোকবর্তিকাস্বরূপ। নিম্নে সংক্ষেপে কুরআন কারীমের পরিচয় ও এর বার্তা তুলে ধরা হলো।

আল-কুরআনুল কারীমের সাধারণ পরিচিতি

এক. আল-কুরআনুল কারীমের পরিচিতি এবং এর নাম ও বৈশিষ্ট্য:

আল-কুরআনুল করীম হচ্ছে মহান আল্লাহ্‌র এমন বাণী, যা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিলকৃত, তার নিকটে এর শব্দ ও অর্থ উভয়টিই ওহী আকারে প্রেরিত, যা মুসহাফে (গ্রন্থাকারে) লিপিবদ্ধ, মুতাওয়াতির সূত্রে (সন্দেহাতীত বহু মানুষ কর্তৃক) বর্ণিত এবং যা তেলাওয়াত করা ইবাদত হিসেবে পরিগণিত।

আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যা ওহী আকারে প্রেরণ করেছেন, তিনি নিজেই তার নাম দিয়েছেন ‘আল-কুরআন’ (অধিক পঠিত) মহান আল্লাহ্ বলেন,

إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ تَنْزِيلًا ٢٣ — الْإِنْسَانِ

‘নিশ্চয় আমরা আপনার প্রতি কুরআন নাযিল করেছি ক্রমে ক্রমে।’ [সূরা আল-ইনসান: ২৩] কারণ, এর বিশেষত্বই এই যে, তা পাঠ ও তেলাওয়াত করতে হবে এবং কখনো পরিত্যাগ করা যাবে না।

আল্লাহ তা‘আলা এর আরেক নাম দিয়েছেন, ‘আল-কিতাব’ (লিখিত গ্রন্থ)। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,

إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ ١٠٥ — النساء

‘আমরা তো আপনার প্রতি সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছি।’ [সূরা আন-নিসা : ১০৫] কেননা, এর মর্যাদা এমন যে, তা লিখতে হবে এবং একে অবহেলা করা যাবে না।

এছাড়াও আল্লাহ্ তা‘আলা আল-কুরআনুল কারীমের কিছু গুণ বর্ণনা করেছেন। যেমন, ফুরকান (সত্য-মিথ্যা পার্থক্যকারী), যিক্‌র (স্মরণ), হুদা (হেদায়াত বা পথনির্দেশ), নূর (আলো), শিফা’ (আরোগ্য), হাকীম (প্রজ্ঞাপূর্ণ), মাউ‘ইযাতুন (উপদেশ) ইত্যাদি গুণসমূহ। এগুলো আল-কুরআনুল কারীমের মাহাত্ম্য ও এর বার্তার পরিপূর্ণতার প্রমাণ।

আর ‘মুসহাফ’ শব্দটি ‘সুহুফ’ (পৃষ্ঠাসমূহ) শব্দ থেকে গৃহীত, যার উপর আল-কুরআনুল কারীম লেখা হয়েছিল। এ নামটি দ্বারা সাহাবীগণ ঐ গ্রন্থকে বুঝাতেন, যার পৃষ্ঠাসমূহে কুরআন লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

বস্তুত আল-কুরআনুল কারীম আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রেরিত ওহী, যা জিব্রীল আলাইহিস্‌সালাম নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরে নাযিল করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,

وَإِنَّهُ لَتَنْزِيلُ رَبِّ الْعَالَمِينَ ١٩٢ نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ ١٩٣ عَلَىٰ قَلْبِكَ لِتَكُونَ مِنَ الْمُنْذِرِينَ ١٩٤ بِلِسَانٍ عَرَبِيٍّ مُبِينٍ ١٩٥ — الشعراء

‘আর নিশ্চয় এটি (আল-কুরআন) সৃষ্টিকুলের রব হতে নাযিলকৃত। বিশ্বস্ত রূহ (জিব্রীল) তা নিয়ে নাযিল হয়েছেন; আপনার হৃদয়ে, যাতে আপনি সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়।’ [সূরা শুআরা : ১৯২-১৯৫]

আর এ ব্যাপারে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাসূলদের মধ্যে নতুন নন। তার রাসূল ভ্রাতৃবৃন্দ (আলাইহিমুস সালাতু ওয়াসসালাম)-এর সবার উপরই জিব্রীল আলাইহিস্‌সালাম আল্লাহ্‌র নিকট থেকে ওহী নাযিল করতেন। আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা এ মহান আমানতের জন্য যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন। মহান আল্লাহ বলেন,

اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ ۚ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ  ٧٥ — الحخ

‘আল্লাহ্‌ ফিরিশ্‌তাদের মধ্য থেকে মনোনীত করেন রাসূল এবং মানুষের মধ্য থেকেও; নিশ্চয় আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা, সম্যক দ্রষ্টা।’ [সূরা আল-হাজ্জ : ৭৫] তিনি ভালো করেই জানেন কে এর জন্য অধিক উপযুক্ত, আর কে এর উপযুক্ত নয়। কারণ, সকল সৃষ্টি তাঁরই তো সৃষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَرَبُّكَ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَيَخْتَارُ ۗ ٦٨ — القصص

‘আর আপনার রব যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন এবং যা ইচ্ছে মনোনীত করেন।’ [সূরা আল-কাসাস : ৬৮]

দুই. কুরআনুল কারীমের নাযিল হওয়া:

৬১০ খ্রিষ্টাব্দের সতেরই রমযান সোমবার সম্মানিত নগরী মক্কার অন্যতম হেরা পর্বতের গুহায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ওহী নাযিলের সূচনা হয়। জিব্রীল আলাইহিস সালাম সেখানে এই আয়াতসমূহ নিয়ে নাযিল হন,

ٱقْرَأْ بِٱسْمِ رَبِّكَ ٱلَّذِى خَلَقَ ١ خَلَقَ ٱلْإِنسَـٰنَ مِنْ عَلَقٍ ٢ ٱقْرَأْ وَرَبُّكَ ٱلْأَكْرَمُ ٣ ٱلَّذِى عَلَّمَ بِٱلْقَلَمِ ٤ عَلَّمَ ٱلْإِنسَـٰنَ مَا لَمْ يَعْلَمْ ٥ — العلق

‘পড়ুন আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন— সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ হতে। পড়ুন, আর আপনার রব মহামহিমান্বিত; যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।’ [সূরা আল-আলাক : ১-৫] এটিই ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিল হওয়া আল-কুরআনুল কারীমের প্রথম অংশ।

তা নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পরিবারের কাছে শঙ্কিত ও ভীত-সন্ত্রস্ত হৃদয়ে ফিরে এলেন এবং আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা তার স্ত্রী উম্মুল মুমেনীন খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ রাদিয়াল্লাহু ‘আন্‌হার কাছে বর্ণনা করে তাকে বললেন, ‘আমি আমার নিজের আত্মার উপর ভয় করছি।’

তখন খাদিজা বললেন, ‘কখনো নয়, আপনি বরং সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহর শপথ করে বলছি, আল্লাহ আপনাকে কখনো অপমানিত করবেন না। নিশ্চয় আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, সত্য কথা বলেন, যারা বহন করতে অক্ষম তাদের পক্ষ হয়ে বহন করে দেন, মেহমানদারী করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন।’

তারপর খাদিজা তাঁকে নিয়ে ওরাকা ইবন নওফেলের কাছে গেলেন, যিনি সঠিক মত বা পরামর্শ ও হিকমতে প্রসিদ্ধ ছিলেন। খাদিজা ওরাকাকে বললেন, ‘চাচা! আপনার ভাতিজা থেকে শুনুন।’

অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা দেখেছেন তার সংবাদ জানালেন, তখন ওরাকা ইবন নাওফেল তাকে বললেন, ‘এই সে-ই নামূস যিনি মূসা আলাইহিস সালামের কাছে নাযিল হয়েছিলেন। হায় আমি যদি তখন যুবক থাকতাম, হায় আমি যদি সেদিন জীবিত থাকতাম যখন তোমাকে তোমার জাতি দেশান্তর করবে।’

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তারা কি আমাকে দেশান্তর করবে?’

ওরাকা বলেন, ‘হ্যাঁ, করবে। তুমি যা নিয়ে এসেছ, অতীতে যিনিই তা নিয়ে এসেছেন তার সাথেই শত্রুতা করা হয়েছে। যদি আমি সে দিন পাই, তবে তোমাকে প্রবলভাবে সাহায্য করব।’

এই সাক্ষাতের কিছু সময় পর ওরাকা মারা যান।

তবে সমগ্র আল-কুরআনুল কারীম একবারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিল হয় নি, যেভাবে পূর্ববর্তী নবীগণ (আলাইহিমুস সালাম)-এর কিতাবসমূহ নাযিল হয়েছিল। বরং তা পৃথক পৃথকভাবে তেইশ বছর যাবৎ নাযিল হয়েছে। একবারে সম্পূর্ণ একটি সূরা কিংবা একটি সূরার কয়েকটি আয়াত নাযিল হতো।

আল-কুরআনুল কারীম পৃথক পৃথকভাবে নাযিল হওয়ার হেকমত হচ্ছে জিব্রীল আলাইহিসসালাম কর্তৃক পুনঃপুনঃ ওহী নাযিল হওয়ার মাধ্যমে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তর সুদৃঢ় করা, তাকে মযবুত করা এবং তাকে সাহায্য করা; যাতে করে তাঁকে রাসূল হিসেবে প্রেরণের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি মুশরিকদের একগুঁয়েমি ও বিরোধীতার মুকাবেলা করতে তিনি অধিক সক্ষম ও স্থির-চিত্ত হতে পারেন। আল্লাহ্ সুবহানাহু বলেন,

وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْلَا نُزِّلَ عَلَيْهِ الْقُرْآنُ جُمْلَةً وَاحِدَةً ۚ كَذَٰلِكَ لِنُثَبِّتَ بِهِ فُؤَادَكَ ۖ وَرَتَّلْنَاهُ تَرْتِيلًا ٣٢ — الفرقان

‘আর কাফেররা বলে, “সমগ্র কুরআন তার কাছে একবার নাযিল হলো না কেন?” এভাবেই আমরা নাযিল করেছি আপনার হৃদয়কে তা দ্বারা মযবুত করার জন্য এবং তা ক্রমে ক্রমে স্পষ্টভাবে আবৃত্তি করেছি।’ [আল-ফুরক্বান : ৩২]

পৃথক পৃথকভাবে আল-কুরআনুল কারীম নাযিল হওয়ার মাঝে আরেকটি শিক্ষামূলক মহান উদ্দেশ্য ও হেকমত রয়েছে; তা হচ্ছে, দ্বীনের হুকুম-আহকাম সম্পর্কে জানা ও আমল করার ক্ষেত্রে ঈমানদারদের পর্যায়ক্রমিক সুযোগ দান করা; যাতে করে তাদের জন্য দ্বীন জানা ও বুঝা এবং পূর্বে তারা যে অজ্ঞতা, কুফর ও শিরকের অন্ধকারে ছিল তা থেকে ঈমান, তওহীদ ও জ্ঞানের আলোয় বের হয়ে আসা সহজ হয়।

তিন. আল-কুরআনুল কারীম লিপিবদ্ধকরণ:

যেকোনো ভাষ্য সংরক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে, লিপিবদ্ধকরণ। কারণ, যে কথা লিখে রাখা হয় না তা ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর আল-কুরআনুল কারীম যেহেতু কিয়ামত পর্যন্ত সৃষ্টিকুলের হেদায়াতের জন্য নাযিল করা হয়েছে সেহেতু তা লিপিবদ্ধ হওয়া জরুরি ছিল।

কুরআন লিপিবদ্ধ করার বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ তত্ত্বাবধান ও গুরুত্ব পেয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কোনো কোনো সাহাবী, যারা লিখতে জানতেন তাদেরকে আল-কুরআনুল কারীমকে লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দিতেন এবং তাদেরকে ওহী লেখক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন, যায়েদ ইবন সাবেত আল-আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যখনই কোনো ওহী নাযিল হতো, তখনই তিনি তা হেফয করে নিতেন। তারপর তিনি যা তার কাছে নাযিল হতো তা কোনো এক ওহী লেখককে লেখার জন্য পড়ে শোনাতেন এবং বলতেন, ‘এ আয়াতগুলো সে সূরায় রাখ যাতে অমুক অমুক বিষয়ের উলেখ আছে।’ এভাবে তিনি তাদেরকে সে সূরার নাম বলতেন এবং তাতে সে আয়াতগুলো লিখে নিতে বলতেন। তারপর তিনি সাহাবীগণকে আল-কুরআনুল কারীমের যা নাযিল হয়েছে তা শিখতে এবং হিফয করতে নির্দেশ দিতেন। এভাবে আল-কুরআনুল কারীম পুরোটাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে বিভিন্ন কাগজ বা চামড়ার টুকরোতে লেখা হয়েছিল।

জিব্রীল আলাইহিস সালাম প্রতি বছর আল-কুরআনুল কারীমকে নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একবার পেশ করতেন। আর যে বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা গেছেন, সে বছর বর্তমানে মুসলিমদের কাছে কুরআনুল কারীমের যে মুসহাফ আছে হুবহু তার আয়াত ও সূরার ক্রমধারা অনুসারে জিব্রীল ‘আলাইহিস সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তা দু’ বার পেশ করেছিলেন। আর তা ছিল মহান ও বরকতময় সত্য আল্লাহর এই বাণীর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন:

إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ ١٧ فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ ١٨  —  القيامة

‘নিশ্চয় এর সংরক্ষণ ও পাঠ করাবার দায়িত্ব আমাদেরই। কাজেই যখন আমরা তা পাঠ করি আপনি সে পাঠের অনুসরণ করুন।’ [সূরা আল-কিয়ামাহ : ১৭-১৮]

আর এই বাণীরও বাস্তবায়ন:

سَنُقْرِئُكَ فَلَا تَنْسَىٰ ٦ — الأعلى

‘শীঘ্রই আমরা আপনাকে পাঠ করাব, ফলে আপনি ভুলবেন না।’ [সূরা আল-আ’লা: ৬]

চার: আল-কুরআনুল কারীমকে পত্রসমূহে একত্রিতকরণ:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর খলীফাতুর রাশেদ আবু বকর আস-সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু আল-কুরআনকে সুশৃংখলভাবে পত্রসমূহে একত্রিত করার নির্দেশ দেন; যাতে হাফেযদের মৃত্যু কিংবা লিখিত কাগজ বা চামড়াগুলো নষ্ট হওয়ার ফলে কুরআনের কোনো অংশ হারিয়ে না যায়। এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন ওহী লেখক যায়দ ইবন সাবিত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু। এই নতুন সংকলনটি পুনঃনিরীক্ষা করা এবং চামড়া/কাগজের পত্রসমূহে লিখিত ও অন্তরে সংরক্ষিত ভাষ্যের সাথে তার অভিন্নতার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর সেই একত্রিত পত্রগুলো আবু বকর আস-সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর গৃহে তার মৃত্যু পর্যন্ত রাখা হয়। তারপরে দ্বিতীয় খলীফা উমর ইবনুল খাত্ত্বাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর গৃহে সেগুলো সংরক্ষণ করা হয়। তার মৃত্যুর পর সেগুলো নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন হাফ্‌সা বিনত উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার গৃহে সংরক্ষিত হয়।

অতঃপর যখন ইসলাম প্রসার লাভ করল, তখন মুসলিমরা কুরআন পড়ার জন্য গ্রন্থাবদ্ধ মুসহাফের প্রয়োজন অনুভব করল। কোনো কোনো সাহাবী খলীফাতুর রাশেদ উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে পরামর্শ দিলেন একটি ‘মুসহাফ ইমাম’ বা প্রধান মুসহাফে মানুষকে একত্রিত করতে, যার অনুসরণ করে মানুষ কুরআন পাঠ করবে। তখন তিনি আবু বকর আস-সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর যুগে যেসব পত্রে কুরআন সংকলিত হয়েছিল তার উপর ভিত্তি করে যায়েদ ইবন সাবিত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নেতৃত্বে একদল লিখতে জানেন এরকম কুরআনের হাফেযকে এই দায়িত্ব দেন। তারা সেই পত্রগুলোকে একটি মুসহাফে গ্রন্থরূপে সংকলন করেন এবং তা থেকে কয়েকটি অনুলিপি তৈরি করেন। এর একটি করে অনুলিপি উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু প্রত্যেক বৃহৎ মুসলিম অঞ্চলে প্রেরণ করেন এবং মুসলিমদেরকে সেগুলো থেকে মুসহাফের আরও কপি করে নিতে নির্দেশ দেন।

বর্তমান বিশ্বে পরিচিত সকল মুসহাফ, হস্তলিখিত হোক বা প্রেসে ছাপা হোক, সেসবের মূল হচ্ছে ঐ মুসহাফগুলো, যেগুলো কপি করে বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়েছিল। সেগুলোর পাঠে কিংবা বিন্যাসে কোনো তারতম্য নেই।

আর আজ পর্যন্ত মুসলিমগণ মুসহাফ শরীফ ছাপার প্রতি এবং মুদ্রণ-শিল্পের নিত্য-নতুন পদ্ধতি, কারিগরী ও প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আসছে; যাতে করে ‘আর-রাসমুল উসমানী’ বলে প্রসিদ্ধ কুরআনের মূলপাঠের যে লিখন-পদ্ধতি খলিফাতুর রাশেদ উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সময়ে গ্রহণ করা হয়েছিল, তা লেখায় সর্বোচ্চ মান ও বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা যায়।

মদীনাতুন নববীয়ায় অবস্থিত বাদশাহ্ ফাহ্‌দ কুরআন শরীফ প্রিন্টিং কম্‌প্লেক্স অনুরূপভাবে আল-কুরআনুল কারীমের প্রতি সর্বোচ্চ যত্নের অন্যতম একটি স্পষ্ট নিদর্শন। এছাড়াও এটি সৌদি আরব রাজ্যের শাসকগণ কর্তৃক আল্লাহ্ তা‘আলার কিতাবের প্রতি গুরুত্বারোপ, এর খেদমতের প্রতি যত্নবান হওয়া এবং মুসলিমদের হাতে সবচেয়ে সুন্দর মুদ্রণ, বাঁধাই, মান, যথার্থতা ও দক্ষতার সাথে পবিত্র কুরআনকে সহজে পৌঁছে দেওয়ার ঐকান্তিক ইচ্ছার সাক্ষ্য বহন করছে।

পাঁচ: কুরআনের বিন্যাস ও বিভাজন:

আল-কুরআনুল কারীম শুরু হয়েছে সূরা আল-ফাতেহার মাধ্যমে এবং শেষ হয়েছে সূরা আন-নাস-এর মাধ্যমে। আর তা মোট ১১৪টি সূরা সম্বলিত। এই বিন্যাসটি ‘তাওকীফী’, অর্থাৎ তা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সরাসরি গৃহীত; আর তাতে নাযিল হওয়ার ক্রমধারা রক্ষিত হয় নি। যেমন, সূরা আল-আলাক্ব প্রথম নাযিল হওয়া সূরা, অথচ কুরআনে তার ক্রম ৯৬তম। সাহাবীগণ সূরা ও আয়াতের বিন্যাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কুরআন পাঠ থেকে জানতেন।

বর্তমানে কুরআনকে ৩০টি পারা বা জুয্’-এ বিভক্ত করা হয়, যার প্রতিটি পারা দু’টি হিয্‌ব (অংশ)-এ বিভক্ত। তারপর প্রতিটি হিয্‌বও চারটি রুব‘ (এক-চতুর্থাংশ)-এ বিভক্ত করা হয়। এই বিভাজনের অধিকাংশই মুসলিমদের জন্য আল-কুরআনুল কারীমের পাঠ সহজ করার উদ্দেশ্যে আলেমগণ কর্তৃক ইজতিহাদ বা গবেষণা।

ছয়: আল-কুরআনুল কারীম শিক্ষা :

মুসলিমগণ আল-কুরআনুল কারীম যেভাবে তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিল হয়েছে সেভাবে তা শেখা, তার মূল-পাঠ হেফ্‌য ও সংরক্ষণ করা এবং তেলাওয়াত করার ব্যাপারে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। সাহাবীগণের মধ্যে যারা কুরআনের ক্বারী বা হাফেয ছিলেন, তারা তাবে‘ঈদেরকে তা শেখানোর কাজে ব্রতী ছিলেন, ফলে তারা এর মূল-পাঠকে পরিপূর্ণভাবে আয়ত্ব করে নিয়েছিলেন। আর তারা সাহাবীগণকে কুরআনের প্রতিটি আয়াতের কাছে থামিয়ে সে আয়াতসমূহের অর্থ সুক্ষ্মভাবে বুঝে নিতেন। এভাবে তাবে‘ঈগণ সাহাবীগণের কাছ থেকে ইলম (জ্ঞান) ও আমল (কর্ম) দু’টোই শিখে নিয়েছিলেন। তারপর তাবে‘ঈগণের মধ্যে যারা হাফেয ছিলেন তারা কুরআন তেলাওয়াতের বিভিন্ন পদ্ধতি, মূল-পাঠের যথার্থ সংরক্ষণ, এর অক্ষর ও শব্দসংখ্যার হিসাব, এর সূরা ও আয়াতসমূহের বিন্যাস, এর তাজভীদ, সুন্দরভাবে আদায় এবং তারতীল পদ্ধতি প্রভৃতি যেভাবে সাহাবীগণ থেকে শিখেছিলেন হুবহু এর অনুসরণ করেই তারা কুরআন শিক্ষাদানের বিভিন্ন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর ফলে অব্যাহতভাবে আজ পর্যন্ত ছাত্র তার হাফেয ক্বারী শিক্ষকদের মুখ থেকে সরাসরি বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় সম্পূর্ণ তরু-তাজাভাবে যেভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিল হয়েছে সেভাবে আল-কুরআনুল কারীমের শিক্ষাগ্রহণ, হেফয ও তেলাওয়াত চলে আসছে।

আর কুরআনুল কারীম বেশ কয়েকটি কেরাআতে পড়া যায়, যেগুলো মূলত আল-কুরআনের অক্ষর ও শব্দ আদায়ের বিভিন্ন পদ্ধতি ও উচ্চারণের নিয়ম-নীতি; যা তাবে‘ঈগণ হাফেয ও ক্বারী সাহাবীগণের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন, আর সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে নিয়েছিলেন এবং তিনিও তাদেরকে অনুমতি দিয়েছিলেন। এসব কেরাআতের মধ্যে আমাদের যুগে প্রসিদ্ধ হচ্ছে, আসেম-এর কেরাআত যা তার ছাত্র হাফ্‌স ইবন সুলাইমানের বর্ণনা; অনুরূপভাবে নাফে‘-এর কেরাআত যা তার ছাত্র ‘ওয়ার্‌শ’ উপাধিতে প্রসিদ্ধ উসমান ইবন সা‘ঈদের বর্ণনা। তদ্রূপ আরও রয়েছে আবু আমর আল-বাছরী থেকে তার ছাত্র আদ্-দূরীর বর্ণনা এবং নাফে‘ থেকে কালূন এর বর্ণনা।

সাত: আল-কুরআনুল কারীমের তাফসীর:

আল-কুরআনের তাফসীর বলতে তার অর্থ বর্ণনাকে বুঝায়। কোনো কথারই উদ্দেশ্য সে পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয় না যতক্ষণ না তা কিসের উপর প্রমাণবহ ও তার অর্থ কী তা যথাযথভাবে জানা না যায়। মহান আল্লাহ তা‘আলা কুরআন পাঠকারীদেরকে কুরআনের অর্থ বুঝার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। আল্লাহ সুবহানাহু বলেন,

كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ ٢٩

‘এক মুবারক কিতাব। এটি আমরা আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরা গ্রহণ করে উপদেশ।’ [সূরা সোয়াদ : ২৯] আয়াতে উল্লেখিত ‘তাদাব্বুর’ শব্দটির অর্থ, ভালো করে বুঝা।

সাহাবায়ে কিরামের কাছে আল-কুরআনুল কারীমের অর্থে যা যা খটকা লাগতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা ব্যাখ্যা করে বর্ণনা করে দিতেন। তবে সে সময়ে তাদের ভাষাগত দক্ষতার ফলে এবং আল-কুরআনুল কারীম তাদের ভাষায় নাযিল হওয়ায় আল-কুরআনুল কারীমের অর্থ সম্পর্কে তাদের অধিক প্রশ্ন করার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু যতই বছর পেরিয়ে যাচ্ছিল ততই মানুষের নিকট তাফসীরের প্রয়োজনীয়তা প্রকটভাবে ধরা পড়ছিল।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তার সাহাবীগণ ও তাদের ছাত্র তাবে‘ঈদের নিকট থেকে প্রাপ্ত ও বর্ণিত আল-কুরআনুল কারীমের তাফসীরই ইলমুত তাফসীরের মূল বীজের রূপ লাভ করেছে; যাকে ‘আত-তাফসীরুল মা’ছুর’ বা প্রামান্য তাফসীর বলে নামকরণ হয়ে থাকে। এটি আল-কুরআনুল কারীম বুঝার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত। কারণ, এটি দ্বারা উম্মতের প্রথম প্রজন্ম তাদের আরবী ভাষায় দক্ষতার কারণে ও আল-কুরআনুল কারীম নাযিল হওয়ার সময়ের যাবতীয় ঘটনা ও সার্বিক অবস্থা অবলোকনের মাধ্যমে আল-কুরআনুল কারীমের আয়াতসমূহ যেভাবে বুঝেছেন, তা আমাদের নিকট প্রকাশ পায়।

তাফসীরের প্রকারভেদ :

বিভিন্ন তাফসীরকারক আলেমগণ ইলম ও জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় আগ্রহী ছিলেন; ফলে তাদের (তাফসীরের) পদ্ধতিও বিভিন্ন ছিল। কিছু তাফসীরগ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীমের অভিধানিক ও ভাষাগত দিক বর্ণনার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে, আবার কিছু তাফসীরগ্রন্থ ফিকহের বিধি-বিধান বর্ণনার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। আর কিছু তাফসীরগ্রন্থ ঐতিহাসিক দিক, কিংবা বিবেক-বুদ্ধিগত দিক অথবা আচরণগত দিক ইত্যাদিকে প্রাধান্য দিয়েছে। এসব বিবেচনায় এনে আলেমগণ তাফসীরকে দু’ভাগে ভাগ করেন:

এক. আত-তাফসীর বিল মা’ছুর, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তার সাহাবীগণ ও তাবে‘ঈদের থেকে বর্ণিত।

দুই. আত-তাফসীর বির্ রায়, অথবা যা সঠিক ইলমী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ইজতিহাদের মাধ্যমে করা হয়েছে।

তাফসীরের সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি ও তার নিয়ম-কানুন :

আল-কুরআনুল কারীমের তাফসীরের ক্ষেত্রে ‘আত-তাফসীর বিল মা’ছুর’ বা প্রমাণ্য তাফসীরই অগ্রগণ্য। কারণ, এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অথবা তার সাহাবীগণ এবং তাদের ছাত্র তাবে‘ঈদের কাছ থেকে প্রাপ্ত, যারা এ বিষয় সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানতেন। যদি ‘আত-তাফসীর বিল মা’ছুর’ এর মধ্যে কোনো আয়াত সম্পর্কে এমন বাড়তি বর্ণনা পাওয়া না যায়, যা এ আয়াতগুলো বুঝার ক্ষেত্রে প্রয়োজন, তখন মুফাসসিরকে নিম্নোক্ত নিয়ম-নীতিগুলোর খেয়াল রাখতে হবে:

আয়াতের অর্থ বর্ণনায় ‘আত-তাফসীর বিল মা’ছুর’ দ্বারা যা সাব্যস্ত হয়েছে তা খেয়াল রাখা এবং এর বিপরীত কিছু নিয়ে না আসা।

আল-কুরআনুল কারীম সাধারণভাবে যে অর্থগুলো নিয়ে এসেছে এবং নবীর সুন্নাত এ আয়াতসমূহের যে অর্থ স্পষ্ট করে দিয়েছে, তা অনুযায়ী তাফসীর করা। সুতরাং উপরোক্ত অর্থসমূহের বিপরীতে গিয়ে কোনো মুফাস্‌সীরের জন্যই কুরআনের তাফসীর করা বৈধ নয়। কারণ, আল-কুরআনুল কারীমের একাংশ অপরাংশের তাফসীর করে, একাংশ অপরাংশের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। আর নবীর সুন্নাত আল-কুরআনুল কারীমের সংক্ষিপ্ত বিষয়কে বিস্তারিতভাবে বর্ণনাকারী এবং তাফসীর ও ব্যাখ্যাকারী।

আরবী ভাষার ব্যাকরণ যেমন, শব্দের চাহিদা, বাক্যের গঠনরীতি এবং ব্যবহারগত ভিন্নতা ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। কারণ, আল-কুরআনুল কারীম আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে, আর তাকে সে ভাষার নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণ করেই বুঝতে হবে।

মুতাশাবিহ বা অস্পষ্ট আয়াতসমূহকে মুহকাম তথা স্পষ্ট আয়াতসমূহের আলোকে বুঝতে হবে। কারণ, কুরআনের একাংশ অপরাংশের তাফসীর করে। আর কুরআনের অধিকাংশ আয়াতই ‘মুহকাম’ স্পষ্ট অর্থবোধক। তবে কুরআনের কিছু আয়াত রয়েছে ‘মুতাশাবিহ’ যার অর্থ কখনো কখনো কারও কাছে সন্দেহপূর্ণ মনে হতে পারে, তখন সে সব মুতাশাবিহ আয়াতকে মুহকাম আয়াতের দিকে ফিরিয়ে দিলে মুহকাম আয়াতগুলো মুতাশাবিহ আয়াতের চাহিদা বুঝতে এবং সেগুলোর অর্থ স্পষ্ট করতে সহযোগিতা করবে। আল্লাহ সুবহানাহু বলেন,

هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ ۖ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ ۗ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ ۗ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ رَبِّنَا ۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ ٧ — آل عمران

‘তিনিই আপনার প্রতি এই কিতাব নাযিল করেছেন যার কিছু আয়াত ‘মুহ্‌কাম’, এগুলো কিতাবের মূল; আর অন্যগুলো ‘মুতাশাবিহ্’; সুতরাং যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে শুধু তারাই ফেৎনা এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে মুতাশাবিহাতের অনুসরণ করে। অথচ আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর তারা বলে, “আমরা এগুলোতে ঈমান রাখি, সবই আমাদের রবের কাছ থেকে এসেছে।’ আর জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা ছাড়া আর কেউ উপদেশ গ্রহণ করে না।” [সূরা আলে ইমরান : ৭]

বিশ্বজগত সম্পর্কিত কুরআনের আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা করার সময় কেবলমাত্র বিজ্ঞানের প্রমাণিত বাস্তব তথ্যের সহযোগিতা নেওয়া। কোনো ক্রমেই বৈজ্ঞানিক মতবাদ আকারের চিন্তাধারাকে আল-কুরআনুল কারীমের তাফসীরের প্রবিষ্ট করা যাবে না। কারণ, এতে করে আল-কুরআনুল কারীমের অর্থে এমন কিছু প্রবেশ হতে পারে যা কুরআন সমর্থন করে না।

মহান আল্লাহর বাণীর অর্থকে পবিত্র শরী‘আতের বাস্তব নিয়ম-নীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং আরবী ভাষার ব্যাকরণের ব্যত্যয় ঘটায়, এমন কোনো অপব্যাখ্যা করা থেকে সাবধান থাকতে হবে; হোক তা বিকৃতির উদ্দেশ্যে; অথবা আরবী ভাষা, এর শব্দার্থ ও তা ব্যবহারের পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে; কিংবা এমন অসিদ্ধ কিছু অর্থ কল্পনা করার কারণে, যেগুলো থেকে আল্লাহ্ তা‘আলার বাণী মুক্ত ও পবিত্র।

আট. আল-কুরআনুল কারীমের ই‘জায (কুরআন কর্তৃক অন্যকে অপারগ করে দেওয়া):

পারিভাষিক অর্থে ই‘জায হচ্ছে, এমন এক গুণ যা অনুরূপ কোনো কিছু নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সাধারণ ক্ষমতাকে অতিক্রম করে যায়, হোক তা কোনো কাজ অথবা মত অথবা পরিকল্পনা। আর মু‘জিযা হচ্ছে নতুন একটি বিশেষণ, যা নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাত ওয়াসসালামের (নবুওয়তের) নিদর্শনাবলি ও প্রমাণাদির জন্য ব্যবহৃত হয়। আল-কুরআনুল কারীমে এ শব্দটি আসে নি; বরং সেখানে আয়াত (নিদর্শন), বুরহান (প্রমাণ) ইত্যাদি শব্দ এসেছে।

আর আল-কুরআনুল কারীম মহান আল্লাহর কথা বা বাণী; তার অর্থের মধ্যে রয়েছে পূর্ণতা, তার আয়াত, বাক্য ও শব্দশৈলীতে রয়েছে পূর্ণ সৌন্দর্য, যার অনুরূপ কোনো কিছু আনতে সকল মানুষই অপারগ। মহান আল্লাহ বলেন,

الر ۚ كِتَابٌ أُحْكِمَتْ آيَاتُهُ ثُمَّ فُصِّلَتْ مِنْ لَدُنْ حَكِيمٍ خَبِيرٍ ١  — هود

“আলিফ-লাম-রা, এ কিতাব, যার আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট, সুবিন্যস্ত ও পরে বিশদভাবে বিবৃত; প্রজ্ঞাময়, সবিশেষ অবহিত সত্তার কাছ থেকে।” [সূরা হুদ : ১]

মুশরিকরা আল-কুরআনুল কারীমের উৎস সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি করতে এবং বিভিন্ন প্রকার মিথ্যা রটনা ও সংশয় উত্থাপনের মাধ্যমে মানুষকে কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি করে নি, তখন আল্লাহ সুবহানাহু বিভিন্ন আয়াত নাযিল করেন, যেগুলোতে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন যে, যদি তারা (তাদের সেসব দাবীতে) সত্যবাদী হয়, তবে যেন এ কুরআনুল কারীমের মত অনুরূপ নিয়ে আসে, অথবা এর মত দশটি সূরা নিয়ে আসে, অথবা একটি সূরা যেন নিয়ে আসে, কিন্তু তারা এতে অপারগ হয় এবং মেনে নেয় যে, আল-কুরআনুল কারীম যদিও এটি আরবী ভাষায় তবুও এর অনুরূপ কিছু তৈরি করা কিংবা এর মতো কিছু নিয়ে আসা কখনও সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ ۖ قُلْ فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِثْلِهِ وَادْعُوا مَنِ اسْتَطَعْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ ٣٨ — يونس

“নাকি তারা বলে, ‘তিনি এটা রচনা করেছেন?’ বলুন, ‘তবে তোমরা এর অনুরূপ একটি সূরা নিয়ে আস এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য যাকে পার ডাক, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’” [সূরা ইউনুস : ৩৮]

আর আল-কুরআনুল কারীম স্পষ্টভাষায় উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছে যে, সকল মানুষ তারপর সকল জিন সবাই একত্রিত হয়ে সম্মিলিতভাবে একে অপরকে সহযোগিতা করে প্রচেষ্টা চালালেও আল-কুরআনুল কারীমের অনুরূপ নিয়ে আসতে সক্ষম হবে না।

قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَىٰ أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَٰذَا الْقُرْآنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا ٨٨ — الإسراء /بني إسرائيل

“বলুন, ‘যদি কুরআনের অনুরূপ কুরআন আনার জন্য মানুষ ও জিন সমবেত হয় এবং যদিও তারা পরস্পরকে সাহায্য করে তবুও তারা এর অনুরূপ আনতে পারবে না’।” [সূরা আল- ইসরা : ৮৮]

আল-কুরআনুল কারীম এ জন্যই মু‘জিয বা অপারগকারী যে, এটি আল্লাহর বাণী, যা মানুষের বাণীর সদৃশ নয়। এর বাক্য, আয়াত ও ভাষাশৈলীতে; এর বিভিন্ন বর্ণনার রীতি-নীতি ও অলংকারিক বৈশিষ্ট্যে; এর সংবাদ ও সত্য কাহিনীতে; এর মধ্যকার বিধি-বিধান ও আইন-কানুনে; এর মধ্যস্থিত আত্মিক ও আধ্যাত্মিক প্রভাবের শক্তিতে এবং এর মধ্যে যে সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের তাক-লাগানো চিরন্তন সত্যের কথা রয়েছে তাতে এটি নিঃসন্দেহে একটি আয়াহ্ বা নিদর্শন ও বুরহান বা প্ৰমাণ।

বহু পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিদ, জীববিজ্ঞানী ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী তাদের স্ব স্ব বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আল-কুরআনুল কারীম কর্তৃক সুক্ষ্ম বিজ্ঞানসম্মত বাক্য ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বাস্তব সত্যের বর্ণনা ও সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন বিষয়াদির প্রতি ইঙ্গিতের ফলে কতই না বিস্ময়বিহ্বল হয়েছে! একজন নিরক্ষর রাসূল, যিনি একটি নিরক্ষর জাতিতে ছিলেন, যার সময়কার বিশ্ব যে সকল বিষয়াদি সম্পর্কে কিছুই জানত না— তার কাছ থেকে এ সকল বিষয় বের হওয়া কল্পনাতীত। এ বিষয়টি তাদের অনেকের ইসলাম গ্রহণের কারণও হয়েছিল। কেননা, তারা হৃদয়াঙ্গম করতে পেরেছিলেন যে, আল-কুরআনুল কারীম যা নিয়ে এসেছে তা কোনো মানুষের বাণী হতে পারে না, বরং তা সৃষ্টিজগত ও মানুষের স্রষ্টারই বাণী।

তাছাড়া মহান আল্লাহর তাওহীদ ও তাঁর অপূর্ব সৃষ্টিশৈলীর উপর প্রমাণবহ বহু আয়াত আল-কুরআনুল কারীমে রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,

سَنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنْفُسِهِمْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ ۗ أَوَلَمْ يَكْفِ بِرَبِّكَ أَنَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ ٥٣ — فصلت / حم السجدة

“অচিরেই আমরা তাদেরকে আমাদের নিদর্শনাবলি দেখাব বিশ্বজগতের প্রান্তসমূহে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে; যাতে তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, অবশ্যই এটা (কুরআন) সত্য। এটা কি আপনার রবের সম্পর্কে যথেষ্ট নয় যে, তিনি সব কিছুর উপর সাক্ষী?” [সূরা ফুসসিলাত : ৫৩]

নয়. আল-কুরআনুল কারীমের অর্থের অনুবাদ:

তরজমা বা অনুবাদ হচ্ছে কোনো কথাকে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় নিয়ে যাওয়া। অনুবাদ এমনিতেই কঠিন কাজ; কেননা, নস বা মূল-পাঠের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ভাষাগত অভিব্যক্তি ও ভঙ্গি। মূল-পাঠ এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করার সময় সেই অভিব্যক্তির ভাষাগত চাহিদা সম্পূর্ণভাবে রক্ষা করা দূরূহ হয়ে দাঁড়ায়।

যদি মানুষের রচিত ভাষ্যের অনুবাদকর্ম এরূপ কঠিন হয়ে থাকে, তবে অনুবাদ কাজটি আরও কঠিন হয় যখন আল-কুরআনুল কারীমের অনুবাদ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। কারণ, সেটি আল্লাহ্‌র বাণী, আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে আরবী ভাষায় নাযিলকৃত, তার শব্দ ও অর্থ সবকিছুই আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে ওহীকৃত; আর কোনো মানুষের পক্ষেই এটা দাবি করা সম্ভব নয় যে, সে আল-কুরআনুল কারীমের সকল অর্থ পূর্ণভাবে আয়ত্ব করেছে, অথবা মূল আরবী পাঠে যেরূপ আছে পুনরায় একে নতুন শব্দে সাজিয়ে সেভাবেই সে উপস্থাপন করতে সক্ষম হবে।

আল-কুরআনুল কারীমের অনুবাদ দূরূহ হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম আলেমগণ আল-কুরআনুল কারীমের প্রচার ও তার রিসালাত বা মূলবার্তা যমীনের সকল জাতি, তাদের ভাষা যা-ই হোক না কেন, তাদের নিকট তা পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। আর এ কাজটি অনুবাদ ব্যতীত কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

আর আল-কুরআনুল কারীমের অনুবাদ অন্য ভাষায় করতে হলে নিম্নোক্ত দু’টির একটি অনুসরণ করতে হবে,

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থের অনুবাদ করা। এটি তাফসীর-বিহীন অনুবাদ, যাতে আল-কুরআনের নস বা মূলপাঠের শব্দসমূহের যে অর্থ তা বর্ণনার উপর নিরস্ত থাকা হয়।

আল-কুরআনুল কারীমের তাফসীর বা ব্যাখ্যাগত অনুবাদ করা, যাতে স্পষ্টতা ও উদাহরণ পেশের সহযোগিতা নেয়া হয়। এটি মূলত আরবী ব্যতীত অন্য ভাষায় আল-কুরআনুল কারীমের তাফসীর।

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থের অনুবাদ যত সুক্ষ্মই হোক, আর অনুবাদক যতই উভয় ভাষায় অভিজ্ঞ হোন এবং আয়াতের অর্থসমূহের ব্যাপারে যতই জ্ঞানী হোন না কেন, সে অনুবাদকে কখনই কুরআন নামকরণ করা যাবে না। এর কারণ দু’টি—

এক. আল-কুরআনুল কারীম মহান আল্লাহ তা‘আলার কালাম বা বাণী। তা আরবী ভাষায় নাযিলকৃত এবং বর্ণনাশৈলী ও নিখুঁত হওয়ার দিক থেকে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আর এর আয়াতসমূহকে আরবী ব্যতীত অন্য ভাষায় নতুন করে সাজিয়ে লেখা তার ‘কুরআন’ নামকরণ বাতিল করে দেয়।

দুই. অনুবাদ মূলত অনুবাদকের উপলব্ধি অনুসারে আল-কুরআনুল কারীমের অর্থ। এটি এদিক থেকে তাফসীরসদৃশ; সুতরাং যেভাবে তাফসীরকে কুরআন বলা যায় না, সেভাবে অনুবাদকেও কুরআন বলা যাবে না।

আর আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ গ্রহণযোগ্য হতে হলে আলেমগণ আল-কুরআনুল কারীমের অর্থ বর্ণনার যে সকল নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করে দিয়েছেন সেগুলো তাতে অবশ্যই পাওয়া যেতে হবে। সাথে সাথে সাবধান থাকতে হবে, যাতে অনুবাদক তার অনুবাদকে আল-কুরআনুল কারীমের বিকৃত অর্থ পেশের ঢাকনা হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে অথবা মুসলিমদের বড় বড় নিদর্শনাবলি, চিহ্নসমূহ ও পবিত্র বিষয়াদির প্রতি কোনো প্রকার খারাপ কিছু পেশ করতে না পারে। আর এ কাজটিই অনেক অনুবাদে পরিলক্ষিত হয়, যার অনুবাদ করেছে কোনো কোনো প্রাচ্যবিদ অথবা অসত্যভাবে ইসলামের দিকে নিজের সম্পর্ক সৃষ্টিকারী কোনো কোনো অনুবাদক; যারা ফাসেদ ও খারাপ আকীদার ধারক-বাহক, মহান দ্বীনে ইসলামের মূল্যবোধকে নষ্ট করতে যাবতীয় প্রচেষ্টাই তারা করে যাচ্ছে, আর এর সহীহ আকীদা ও সহজ-সরল শরী‘আতকে আক্রমণ করতে তারা বদ্ধপরিকর।

এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে রেখে মদীনাতুন নববীয়ায় অবস্থিত বাদশাহ ফাহ্‌দ কুরআন প্রিন্টিং কম্প্লেক্স তার কাঁধে বিভিন্ন ভাষায় আল-কুরআনুল কারীমের গ্রহণযোগ্য অর্থানুবাদ বের করার দায়িত্ব নিয়েছে। তার আকাঙ্ক্ষা যে, এর মাধ্যমে আল-কুরআনুল কারীমের মহান রিসালাত বা মূল-বার্তা অনারব ভাষাভাষীদের কাছে তাদের মূল ভাষায় পৌঁছুবে।

সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য; আর আল্লাহ সালাত পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ এর উপর, তাঁর পরিবার-পরিজন, সকল সঙ্গী-সাথী ও কিয়ামতের দিন পর্যন্ত যারা সুন্দরভাবে তাদের অনুসরণ করবে তাদের সবার উপর।

  • ‘নামূস’ শব্দ দ্বারা জিব্রীল আলাইহিস সালামকে বুঝানো হয়েছে। তিনি সেই ফেরেশতা যিনি নবীদের কাছে ওহী নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন।
  • দেখুন: তাফসীরুত তাবারী, ১৯/১০; আবূ শামা আল-মাকদিসী: আল-মুরশিদ আল-ওয়াজীয, পৃ. ২৮।
  • তাফসীরুত তাবারী ১/২৮।
  • সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ৭৮৬; সুনান তিরমিযী, হাদীস নং ৩০৮৬; অনুরূপভাবে হাকিমও তার মুস্তাদরাক গ্রন্থে তা উল্লেখ করেছেন (হাদীস নং ৩৩২৫) আর বলেছেন, ‘এ হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্তের উপর সহীহ, তবে তারা এটিকে উল্লেখ করেন নি।’
  • সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৫৯২, ৪৫৯৩।
  • সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৯৮৬; সুনান আত-তিরমিযী, হাদীস নং ৩১০৩; মুসনাদে ইমাম আহমাদ, হাদীস নং ৭৬।
  • দানী তার মুক্বনি‘ গ্রন্থে (পৃ. ৭) ইমাম মালিক ইবন আনাস থেকে তা বর্ণনা করেন।
  • দেখুন, যারকাশী, আল-বুরহান, ১/১৩।
  • দেখুন, তাফসীরুত-তাবারী, ১/৩৭; ইবন তাইমিয়্যা, মুকাদ্দামাতু উসূলিত তাফসীর, পৃ. ৩৫
  • দেখুন, আয়াতসমূহ, আল-আন‘আম (৭); আল-আন‘আম (২৫); আল-আম্বিয়া (৫); সাবা (৪৩); ইয়াসীন (৬৯); আস-সাফফাত (৩৬); সোয়াদ (৪); আত-তূর (৩০)।
  • দেখুন, আয়াতসমুহ, আল-বাকারাহ (২৩); ইউনুস (৩৮); হৃদ (১৩) আত-তূর (৩৪)।
  • দেখুন, ইবন মানযূর, লিসানুল আরব (শব্দমূল: ترجم ও رجم)।
  • দেখুন, ইবরাহীম আনীস, দালালাতুল আলফায, পৃ. ১৭১-১৭৫; মুহাম্মাদ ‘আওদ্ব মুহাম্মাদ, ফান্নত তারজামা, পৃ. ১৯।
  • ইবন তাইমিয়্যা, মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ৪/১১৬।
  • ইবন তাইমিয়্যা, মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ৪/১১৫, ৫৪২; মুহাম্মাদ হুসাইন আয-যাহাবী, আত-তাফসীর ওয়াল মুফাসসিরূন, ১/২৩।
  • নাওয়াভী, আল-মাজমূ‘ শারহুল মুহায্‌যাব, ৩/৩৪২।